প্রধানমন্ত্রী হবো ক্যামনে Hot News

সহকর্মীদের সঙ্গে প্রায়ই আমাদের খুনসুটি হয়। সহকর্মী মানে মন্ত্রী ও এমপিদের সঙ্গে। আমরা একে অপরকে কথার মাধ্যমে সুড়সুড়ি দেই। নিজেরাও আনন্দ পাই। আবার অন্যকেও দেই। মাঝ থেকে চা, কফি, সিগারেট কিংবা বুট, মুড়ি, পেঁয়াজু জুটে যায় ফাও হিসেবে। যারা এমপি তারা প্রতিমন্ত্রীদের বলি আপনার পারফর্মেন্স খুবই ভালো। পূর্ণমন্ত্রী হওয়ার খুবই সম্ভাবনা। পূর্ণমন্ত্রীদের আরও ভালো ভালো কথা বলি। সিনিয়র এমপিদের সান্ত্বনা দেই নতুন লিস্ট হয়েছে। আগামী মাসে হয়তো মন্ত্রী পরিষদে পরিবর্তন হবে এবং আমরা নিশ্চিত, আপনার নাম সেখানে আছে। গত চারটি বছর জাতীয় সংসদের লবিতে আমরা এ ধরনের আড্ডামূলক কথাবার্তা প্রায়ই বলে আসছি। এ সব আলাপ করতে আমাদের খুবই ভালো লাগে। আর যাকে উদ্দেশ্য করে এসব বলা হয়, তারও ভালো লাগে। এ কারণে প্রশংসিত ব্যক্তিই সাধারণত আপ্যায়নের ব্যবস্থা করেন। এসব নিয়ে এখনো আমাদের মাঝে কোনো ঝামেলা হয়নি। কেউ অভিযোগ করেননি যে, কেন এখনো কিছু একটা হলো না তোমরা বলার পরও। কিংবা আমার চা-কফি-সিঙ্গাড়া বা বুট-মুড়ি-পেঁয়াজু ফেরত দাও।

আমরা এসব কাজ করে আসছি গত চার বছর ধরে। নিরবচ্ছিন্ন ও নিরলসভাবে। অত্যন্ত সূচারুভাবে আমরা বিবেক-বুদ্ধি খাটিয়ে আমাদের দৃষ্টিতে ভালো ভালো মানুষকে বাছাই করে প্রশংসা করে আসছি। কিন্তু আমরা প্রতিবারই ফেল মেরেছি এবং আমাদের নির্বুদ্ধিতা অকপটভাবে প্রমাণ করে আসছি। কেননা আমাদের অনুমান মতো একজন মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী হননি। এত দুর্বল মন-মস্তিষ্ক নিয়ে অনেকের মতো আমিও ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো চিন্তাই করি না, ঠিক বোকারা যেমনটি করে থাকে। এবার শিরোনাম প্রসঙ্গে আসি। আমরা যারা খুব ছোট এমপি তারা আগামীতে মনোনয়ন এবং নিজ এলাকায় কিভাবে জয়লাভ করা যায়_ কেবল এসব নিয়ে আলোচনা করি। আমরা অতি বিনয়ের সঙ্গে সামনা-সামনি একে অপরের প্রশংসা করি। একজন যদি জিজ্ঞাসা করেন_ কী, আমার ব্যাপারে কোনো খবর আছে কি? আমরা বলি, খুব ভালো খবর। শুনলাম এলাকার সাধারণ মানুষ নাকি সব আপনার পক্ষে। কিছু টাউট-বাটপার শুধু আপনার বিরুদ্ধে। আপনি তাদের অপকর্ম করতে দেন না এবং এ কারণেই যত বিরোধ। প্রশ্নকর্তা খুবই আহ্লাদিত হয়ে পড়েন। এরপর প্রশ্ন করেন_ ওই দিকের খবর কি? উত্তর দেই, সবই আপনার পক্ষে। একটু সমস্যা ছিল কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বিচক্ষণভাবে সামস্যা সৃষ্টিকারীদের তাড়িয়ে দিয়েছেন। কৃতজ্ঞতায় প্রশ্নকারীর মুখমণ্ডল উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। অন্তর থেকে প্রধানমন্ত্রীকে দোয়া করেন এবং সাধ্যমতো আমরা একে-অপরকে আপ্যায়ন করি।

বিগত দিনে আমি অনেক আড্ডাতেই অংশগ্রহণ করেছি। সংসদ সদস্য, মন্ত্রী, আমলা, দেশি-বিদেশি কূটনৈতিক ব্যক্তিত্ব, ব্যবসায়ী, সম্পাদক, সাংবাদিকসহ অনেকেই ঘরোয়া পরিবেশে বা কোনো হোটেলে কিংবা ক্লাবে এসব আড্ডার আয়োজন করে থাকেন। কখনো বিভিন্ন পেশার ৫০/৬০ জন বা ক্ষেত্র বিশেষে ৪০০/৫০০ জন পর্যন্ত হয়। অনেক রাত অবধি চলে খাবার দাবার। আড্ডা এবং পানাহার। আমি এ যাবৎ শুধু খেয়েই এসেছি। আমার কৃপণতা অথবা অর্থের অপর্যাপ্ত জোগান_ আমাকে নিরুৎসাহিত করে এসব অনুষ্ঠান আয়োজনের কিন্তু তারপরও সবাই আমাকে দাওয়াত দেন। আমার বাচালতা, ক্ষেত্র বিশেষে ভাড়ামো এবং মানুষের মন বুঝে কথা বলার দক্ষতার কারণে আমন্ত্রিত অতিথিরা আমাকে পছন্দ করেন। আমি যেখানে বসি বা দাঁড়াই সেখানেই বেশি ভিড় হয়। সভাস্থল জমজমাট হয়ে ওঠে। আমন্ত্রণকারীও আমার প্রতি সন্তুষ্ট থাকেন তার অনুষ্ঠানকে হাস্যজ্জ্বোল ও প্রাণবন্ত করার জন্য।

যখন আড্ডা হয়_ সব প্রসঙ্গ ছাড়িয়ে বাংলাদেশের সমসাময়িক রাজনীতি নিয়েই আলোচনা জমে ওঠে। একটি জিনিস লক্ষ্য করলাম কেউ কোনোদিন বলেননি আমি বা তিনি আওয়ামী লীগ, বিএনপি অথবা জাতীয় পার্টির সভাপতি কিংবা সাধারণ সম্পাদক হওয়ার আশা করি। অথবা আমি ভবিষ্যতে দেশের প্রধানমন্ত্রী কিংবা রাষ্ট্রপতি হতে চাই। অথবা অমুক ব্যক্তি হতে পারেন বা যোগ্যতা রাখেন। আবার এমন কোনো কথাও শুনিনি যে কেউ বলেছেন, ওমুক ব্যক্তি প্রচলিত রাজনৈতিক ধারার বাইরে গিয়ে তার সম্মোহনী ও জাদুকরী নেতৃত্বের গুণে বর্তমান শীর্ষ রাজনৈতিক নেতৃত্ব বা দলকে সরিয়ে নতুন একটি দল গঠন করার ক্ষমতা রাখে না। বরং নিরন্তর সীমাহীন অভিযোগ ও অনুযোগ উত্থাপিত হয় প্রচলিত শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে। আমাকে মূল্যায়ন করা হলো না। ওমুককে বেশি সুযোগ দেওয়া হয়েছে, ওমুকের প্রতি বেশি দয়া ও অনুকূল্য প্রদর্শন করা হয়েছে। আমাদের সঙ্গে পরামর্শ করা হয় না_ ইত্যাদি সব অভিযোগ হর হামেশাই শুনি- আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির রাজনীতি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের কাছে।

প্রথম দিকে এসব শুনে খুবই ব্যথিত হতাম। আবার অভিযোগকারী নেতৃবৃন্দ যখন তাদের সিনিয়র নেতৃবৃন্দের মুখোমুখি হন তখন এমন প্রশংসাসূচক বাক্য ব্যবহার করেন যাতে মনে হয় তাদের চৌদ্দগোষ্ঠীর মধ্যে কেউ কখনো কোনো অভিযোগই করেননি। একই অঙ্গে ব্যক্তির এই বহুরূপিতা আমাকে প্রথম দিকে খুবই আশ্চর্য করে তুলত। এখন আর করে না। কারণ আমি বুঝেছি, এটাই বাস্তবতা। এবার আমি নিজের নির্বাচনী এলাকার কিছু তিক্ত রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার কথা বলে প্রসঙ্গে ফিরে আসছি। ক্ষমতাসীন দলের এমপি হিসেবে আমার অবস্থান আমার নির্বাচনী এলাকায় তেমনি যেমনটি বৃহত্তর পরিসরে ক্ষমতাসীন অন্য ব্যক্তিবর্গ ভোগ করে থাকেন। কাজেই নির্ভুলভাবে আমার অবস্থান ব্যাখ্যা করলেই জাতীয় রাজনীতির ক্ষমতার কেন্দ্রগুলোর পরিবৃত্তে কি হচ্ছে তা সম্মানিত পাঠকবৃন্দ সহজেই বুঝতে পারবেন।

এমপি হওয়ার আগেই আমার চিন্তা ছিল রাতারাতি ভালো কিছু করে সবাইকে চমক লাগিয়ে দেব। জনকল্যাণের আশা তো ছিলই। কিন্তু মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল সবাইকে চমক লাগিয়ে দেওয়া। আমার চিন্তাপ্রসূত প্রকল্পসমূহ ও নীতিমালাসমূহ ছিল অতিশয় আধুনিক এবং একই সঙ্গে জনহিতকর। কাজেই এগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমি ছিলাম অতিমাত্রায় আত্দবিশ্বাসী। এসব কর্মকাণ্ডে আমার ব্যক্তিগত, পারিবারিক বা রাজনৈতিক অভিলাষ ছিল না, কেবল চমকিত করে দেওয়ার মনোভাব একান্তই মানবীয় বৈশিষ্ট্য বলে এতে পাপবোধ করিনি। আমার অতিরিক্ত আত্দবিশ্বাসই কাজের প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়াল। বিভিন্ন রাজনৈতিক পক্ষ, স্থানীয় গণ্যমান্য সমাজপতিরা এবং প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা মনে মনে চাইতেন আমি তাদের একটু ডাকি। চা খাওয়াই এবং বিনয়ের সঙ্গে আমার পরিকল্পনাসমূহ তাদের বলি। সর্বশেষে এ কাজের দায়িত্ব তাদের ওপর ন্যস্ত করি। আমি বুঝেও না বোঝার ভান করতাম এবং ইচ্ছা করেই তাদের ডাকিনি। কারণ আমার আত্দবিশ্বাস আমাকে প্রেরণা দিচ্ছিল_ যেহেতু প্রকল্পসমূহ অত্যন্ত জনহিতকর কাজেই এসব নিয়ে এত পিউপিউ করে আলোচনার কি দরকার। অন্য দিকে যে সব লোক আমার সঙ্গে আলোচনার আগ্রহ দেখাচ্ছিল তাদের প্রায় সবার বিরুদ্ধে জনগণের এন্তার অভিযোগ ছিল। আমি নিজেও তাদের অসৎ, অযোগ্য এবং অকর্মণ্য হিসেবে জানতাম। ফলে আমার কোনো কাজেই তাদের পরামর্শ নিলাম না। তারা প্রথমে আমার কাছ থেকে দূরে থাকল। তারপর শুরু করল দশমুখে সমালোচনা। এবং সব শেষে তারা আমার প্রতিপক্ষসমূহের রাজনৈতিক শক্তি ব্যবহার করে আমার কাজে নানা রকম প্রতিবন্ধকতা শুরু করল। যে নিরীহ ও সাধারণ মানুষের কথা ভেবে আমি এসব করলাম সেই মানুষ কিন্তু আমার জন্য রাস্তায় নামল না। তারা আমাকে সমর্থন করে বটে কিন্তু ওইসব লোকের সামনে মুখফুটে কিছু বলে না। ফলে আমার ভালো ভালো প্রকল্পের কয়েকটি বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হয়ে আটকে পড়ল। আমিও হতাশ হয়ে পড়লাম। এখন আমাকে নতুন করে সবকিছু ভাবতে হচ্ছে। আমি যাদের দুর্নীতিবাজ, অদক্ষ এবং বাজে প্রকৃতির লোক বলে দূরে সরিয়ে রাখলাম, কিছুদিন পর লক্ষ্য করলাম তাদেরও বেশ বড়সড় একটি গ্রুপ বা গোষ্ঠী রয়েছে। এরা সমাজের সাধারণ মানুষের ওপর জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে আছে। জনগণ আমার সামনে এসে ওই সব লোকের বিরুদ্ধে কথা বলে বটে কিন্তু প্রয়োজনে আবার ওদের কাছে ধরনাও দেয়। গ্রাম্য সালিশে পক্ষপাতিত্ব, থানার দালালি, কোর্টের দালালি, ভূমি অফিস, ইউএনও অফিস, ইঞ্জিনিয়ার অফিসসহ সরকারি দফতর থেকে অনৈতিক স্বার্থ আদায়ের জন্য জনগণ প্রতিনিয়ত এসব লোকের কাছে যায়। আমি বা আমার মতো নির্বোধদের না জানিয়ে জনগণ ওইসব লোকের কাছে জায়গা-জমি বিক্রি করে টাকা দিয়ে আসে অনৈতিকভাবে সাহায্য লাভের আশায়। এ বাস্তব অবস্থা বুঝতে আমার তিনটি বছর সময় লেগেছে। কিন্তু ততদিনে অনেক কিছুই ঘটে গেছে।

বাস্তব অবস্থা বুঝতে না পারার আরও একটি ব্যর্থতার উদাহরণ দিয়ে প্রসঙ্গে চলে যাব। লোকজন যখন আমার সামনে উপস্থিত হয় তারা সবাই আমার প্রতি অতিশয় বিনয় প্রকাশ করে। তারা আমার পছন্দমতো প্রশংসাসূচক বক্তব্য দিতে আরম্ভ করে এবং অনেকটা জোর করেই আমায় কদমবুচি করে। স্বার্থের জন্য আমার আব্বা-আম্মার বয়সী লোকজনও এ কাজ করে। আমি প্রথম দিকে প্রবল বাধা দিয়েও তাদের নিবৃত্ত করতে পারিনি। অনেকে আমার জন্য কান্নাকাটিও করে। তারা বলে আমাকে নিয়ে ওমুক স্বপ্ন দেখেছে। আমি নাকি মন্ত্রী হয়েছি। প্রধানমন্ত্রী আমাকে ডেকে মাথায় হাত বুলিয়েছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব স্বপ্ন দেখে তারা নাকি খুবই আনন্দিত। খাসি জবাই করে মিলাদ পড়িয়েছে এবং আমার জন্য মিলাদের তবারক নিয়ে এসেছে। তারা আমাকে নিজ হাতে এসব তবারক খাইয়ে দিত এবং সবাই হাত তুলে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আমার জন্য দোয়া করত। আমার এমপি নির্বাচিত হওয়ার ২/১ মাসের মধ্যেই তারা আমার ত্রুটিগুলো রপ্ত করে ফেলল। আমার কাছ থেকে কিভাবে স্বার্থ আদায় করা যায় তার প্রতিটি সূত্রই তাদের মুখস্ত হয়ে গেল। ধর্ম-কর্মে আমার ভক্তি-শ্রদ্ধার কারণে আমার সামনে আল্লার দোহাই এবং কথায় কথায় সুবানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, লা হাওলা, নাউযুবিল্লাহ এবং ইন্নালিল্লাহি উচ্চারণ করত। গরিব দুঃখীদের প্রতি আমার অতি দুর্বলতার কারণে দরিদ্রবেশে গ্রামের পুরুষ ও মহিলা সাজিয়ে এনে নিখুঁতভাবে কান্নাকাটি করিয়ে তাদের প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে আমাকে ক্ষেপিয়ে তুলত। আমি বিভ্রান্ত হয়ে প্রায়ই ভুল সিদ্ধান্ত দিতাম। আমার এই ভ্রান্তি কাটতে কম করে হলেও এক বছর লেগেছে। নবম জাতীয় সংসদে ৫০ বছরের নিচে যেসব সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে আসেন তাদের মধ্যে অনেককে নিয়ে মানুষ ভালো ধারণা পোষণ করেন। যেসব তরুণ সংসদ সদস্যের শিক্ষা, সততা এবং চমৎকার কর্মনৈপুণ্য নিয়ে বোদ্ধামহলে ইতিবাচক আলোচনা হয়, আমি তাদের অন্যতম। সেই আমি রাজনৈতিক জীবনের হাজারো ভুলের মধ্যে কয়েকটি উল্লেখ করলাম মাত্র, যাতে করে এই জগতের সাধারণ ভুলভ্রান্তি সম্পর্কে মানুষ সজাগ হতে পারে। এগুলো বলার উদ্দেশ্যে হলো আমরা প্রতিনিয়ত ভুল করে যাচ্ছি। কিন্তু স্বীকার করছি খুব কমই। এবার প্রসঙ্গে আসি_ 'প্রধানমন্ত্রী হবো ক্যামনে!' শিরোনাম দেখে কেউ কেউ হয়তো ভাবতে পারেন, আমি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার উপায় খুঁজছি। প্রকৃত ঘটনা কিন্তু উল্টো। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন আমি কাউকে লালন করতে দেখেনি। কারও কারও অন্তরে হয়তো থাকতে পারে। কিন্তু তা কেবলই স্বপ্ন। স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দেওয়ার জন্য যে চিন্তা, চেতনা ও কর্মযোগ থাকা দরকার তার কোনো নমুনা সমসাময়িক রাজনীতিতে নেই বললেই চলে। আমরা পরিশ্রমের মাধ্যমে কোনো কিছু অর্জনের চাইতে কারও অনুগ্রহ বা দয়ার প্রাপ্তিকেই উত্তম বিবেচনা করতে অভ্যস্থ হয়ে গেছি। ১৯৯১ সাল থেকে সংসদীয় গণতন্ত্র চালু হওয়ার পর বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট ও মহাজোট একাধিকবার ক্ষমতায় এলো। বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম জিয়া এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাই একাধিকবার প্রধানমন্ত্রী হলেন। তারা দলীয় প্রধানও বটে। এখন পর্যন্ত তাদের কাছাকাছি নেতৃত্ব তো দূরের কথা, ধারে-কাছে দাঁড়াবার মতো ব্যক্তি বা ব্যক্তিত্ব গত ৩০ বছরে দেখা যায়নি। দূর থেকে কারও নূ্যনতম ফুঁসফুাঁস কিংবা বাঁকা চাহনি অতি অল্পকালের মধ্যেই হারিয়ে গেছে বিস্মৃতির অতল গহ্বরে। এর কারণ দুভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। প্রথমত, দলগুলোর শীর্ষ নেতৃত্ব হয় সর্বগুণে গুণান্বিত। দ্বিতীয়ত, দলগুলোর অনুসারীর মধ্যে ভিশন, মিশন কার্যকর করার প্রজ্ঞাবান নেতৃত্বের মহা সংকট রয়েছে। বিএনপিসহ অন্য রাজনৈতিক দল সম্পর্কে আমার তেমন অভিজ্ঞতা নেই। তবে আমার দল সম্পর্কে আমি অনেক কিছুই জানি এবং অনেক বিষয় মনমস্তিষ্কের সর্বোচ্চ চিন্তা-চেতনা দিয়ে উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছি। আমার দলে আগামী ২৫ বছরের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী হবেন এ স্বপ্ন কেবল প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং বা তার ইচ্ছাতে পরিবারের অন্য কেউ দেখতে পারেন। প্রধানমন্ত্রীর কর্মদক্ষতা ও সার্বিক পরিস্থিতি তাকে এ স্বপ্ন দেখতে প্রেরণা জোগায়। অন্য কেউ যে এ স্বপ্ন দেখতে পারছে না, তার জন্য আমাদের কর্মহীনতাই দায়ী। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাকে একান্তভাবে দেখার সুযোগ আমি কম পেয়েছি। কিন্তু বিরোধী দলের নেতা ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী হিসেবে একাধিকবার তার সফরসঙ্গী হওয়ার বিরল অভিজ্ঞতা রয়েছে। আমি প্রধানমন্ত্রীর সামনে না গিয়ে পেছনে থেকে অনেক কিছু দেখার চেষ্টা করেছি। তাকে ঘিরে নেতৃবৃন্দ কেমন করেন আবার পর্দার আড়ালে কি করেন তারই কিছু অভিজ্ঞতা বর্ণনার মাধ্যমে শিরোনামের সারবত্তা প্রমাণের চেষ্টা করব।

তিনি তখন বিরোধীদলীয় নেত্রী। জলিল ভাই সাধারণ সম্পাদক। কাদের ভাই যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং নেত্রীর খুবই কাছের। আমরা কয়েকজন কাদের ভাইকে কেন্দ্রে রেখে দলের জন্য কাজ করতাম। এ গ্রুপে ছিলেন আবদুস সোবহান গোলাপ, সাবেক ছাত্রনেতা বারী, সুজিত রায় নন্দী ও ছাত্রলীগ নেতা রাসেল। আমিও মাঝে-মধ্যে এ দলের সঙ্গে যোগ দিতাম ও বিভিন্ন জেলায় সাংগঠনিক সফরে যেতাম। আমি তখন দামি লেঙ্াস জিপ চালাতাম এবং কাদের ভাই আমার গাড়িতে চড়তে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। এ নিয়ে অনেকে আমাকে হিংসা করত এবং কাদের ভাইয়ের সমালোচনা করত। কাদের ভাই তাদের সুকৌশলে বোঝাতেন। এসব সাংগঠনিক সফরে জলিল ভাইও যেতেন অহরহ। এর বাইরে নেত্রীর কোনো প্রোগ্রাম হলে চারদিকে সাজ সাজ রব পড়ে যেত। খুলনার বরেণ্য আওয়ামী লীগ নেতা মঞ্জুরুল ইমাম নিহত হলে নেত্রী সিদ্ধান্ত নিলেন বিভাগীয় শহরটিতে জনসভা করবেন। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম নেত্রীর সফরসঙ্গী হব।

বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে নেত্রী পুলিশের প্রটোকল পেতেন। কাজেই রীতিমতো তার বহরে যেতে হলে গাড়ির নাম নম্বরসহ আগেই পুলিশকে জানাতে হতো। আমার গাড়ি প্রটোকলের মধ্যে স্থান পেল ওবায়দুল কাদেরের কারণে। আমরা যথারীতি রওনা করলাম। কিন্তু নেত্রীর গাড়িবহরে প্রটোকলের মধ্যে থাকা খুবই দুরূহ বিষয়। এক নেতার গাড়ি ধাক্কা-ধাক্কি করে অন্য নেতার গাড়িকে পেছনে ফেলে দেয়। পুরান ঢাকার হাজী সেলিমের গাড়ি ধাক্কা-ধাক্কি করে কয়েকবার আমাদের পেছনে ফেলে দিলো। গাড়ির সামনে বসা গোলাপ ভাই প্রচণ্ড ক্ষেপে জানালার গ্লাস নামিয়ে গালাগালি করলেন। কিন্তু কাজ হলো না। এর পর আবদুল জলিল সাহেবের গাড়ি আমাদের আরেক দফা ধাক্কিয়ে পেছনে ফেলে দিল। এভাবে ধাক্কা খেতে খেতে আমরা যখন সাভার পেঁৗছালাম তখন আমাদের গাড়ির স্থান হলো বহরের শেষ মাথায়। কাদের ভাইকে বেশ বিব্রত মনে হলো।

আমরা যখন আরিচা ফেরিঘাটে পেঁৗছলাম তখন স্থানীয় নেতা কর্মীরা আমাদের অভ্যর্থনা জানিয়ে ফেরিতে উঠালেন। নেত্রীর জন্য ভিআইপি রুম ছিল। আমরা প্রথম শ্রেণীর রুমটিতে বসলাম। মানিকগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগ নেতারা ফেরিতে বেশ জাঁকজমকপূর্ণ খাবার-দাবারের আয়োজন করেছিল। আমরা সিনিয়র জুনিয়ার ভেদাভেদ না করেই খাবারের জন্য হুড়াহুড়ি শুরু করলাম। আত্দমর্যাদা সম্পন্ন কয়েকজন কিছুই খেলেন না। কিন্তু তাতে কি? বা কে কার খবর রাখে। বুভুক্ষুতা আমাদের এতটাই নির্মম করে তুলল যে, আমরা কেউ কারও প্রতি সৌজন্য বোধ দেখানোর প্রয়োজনও মনে করলাম না। ফেরি পার হয়ে আমরা খুলনা যাওয়ার আগে ঝিনাইদহ সার্কিট হাউসে মধ্যাহ্ন বিরতি এবং খাবারের জন্য থামলাম। ইতোমধ্যে অনেকগুলো পথসভা হয়েছে। নেত্রী বক্তব্য দিয়েছেন। আমরা তো কিছুই করিনি। তারপরও ক্লান্তিতে জীবন যায় যায়। অনেকে ঢাকা ফিরে গেলেন আবার অনেকে ঝিনাদহে রাতযাপনের সিদ্ধান্ত নিলেন। ঝিনাইদহ সার্কিট হাউসে খাবার খাওয়া নিয়ে আরও বিশ্রী ঘটনা ঘটল। পর্যাপ্ত আয়োজন থাকা সত্ত্বেও খাবার নিয়ে কাড়াকাড়িতে অনেকে খেতেই পারল না। এর মধ্যে এক বুদ্ধিমান নেতা রসিকতা করে খাসির মাংসের পাত্র থেকে এক টুকরা মাংস নিয়ে যদি বলতে পারেন_ 'হরিণের মাংসটা তো ভারি সুন্দর হয়েছে'! আর যায় কোথায়! সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ল মাংসের পাত্রের ওপর।

প্রচণ্ড ক্লান্তিতে নেতাদের অনেকেই সার্কিট হাউসে ঘুমিয়ে পড়লেন। নেত্রী কিন্তু ঘুমালেন না বরং ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালে গেলেন জনৈক আহত ও চিকিৎসাধীন আওয়ামী লীগ নেতাকে দেখার জন্য। আমিও ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম ভাঙল জলিল ভাইয়ের ডাকা-ডাকিতে। আমি যে রুমে ঘুমিয়েছিলাম সে রুমেই পান্না নামের যুব মহিলা লীগের এক নেত্রীও ঘুমিয়ে পড়েছিল। পান্না জলিল ভাইয়ের গাড়িতে সফর করছিল। পান্নাকে খুঁজতে এসে আমাকেও ঘুম থেকে উঠানো হয়। আমরা খুলনার উদ্দেশে রওনা করলাম। রাত আনুমানিক ৮টার দিকে যশোরের অভয়নগরে আমরা পেঁৗছলাম। এটি পথসভা হলেও জনসভায় পরিণত হয়েছে। প্রায় ২০/২৫ হাজার লোক সেই বিকাল ৩টা থেকে অপেক্ষা করছিল আমাদের জন্য। আমাদের মানে কেবল নেত্রীর জন্য। এখানেই আমি এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হই।

ঝিনাইদহ থেকে খুলনা যাওয়ার পথে অনেকগুলো নির্ধারিত এবং অনির্ধারিত পথসভা থাকার কারণে অস্বাভাবিক দেরি হচ্ছিল। নেত্রী পুরো বহরটিকে দুভাগে ভাগ করে জলিল ভাই কাদের ভাইয়ের নেতৃত্বে একটি অগ্রগামী দল করলেন। এদের কাজ হলো_ আধাঘণ্টা বা একঘণ্টা আগে সভাস্থলে পেঁৗছে জনগণকে শান্ত করা এবং নেত্রীর বক্তব্যের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। নেত্রী না আসা পর্যন্ত বক্তব্য চালিয়ে যাওয়া। আবার নেত্রী উপস্থিত হলে তাকে মাইক হস্তান্তর করে অন্য পথসভার উদ্দেশে রওনা করা। এভাবেই চলছিল। ছোট ছোট কয়েকটি পথ সভায়। কিন্তু বিপত্তি বাধল অভয়নগরে।আমরা যখন সেখানে পেঁৗছলাম। মাইকে ঘোষণা করা হলো 'মাননীয় সভানেত্রী' আসছেন। ২০/২৫ হাজার লোক শুরু করল স্লোগান। অন্য কোনো কথা নয়। শুধু শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনা। আমরা যখন মঞ্চে উঠলাম তখন স্লোগানের গতি আরও বাড়ল। বুড়া, গুড়া, যুবক সব একসঙ্গে লাফাতে শুরু করল। সে কি লম্ফ না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। আমাদের নিয়ে জলিল ভাই মাইক হাতে দাঁড়িয়ে রইলেন। প্রায় দশ মিনিট এরকম লাফালাফি চলল। থামার কোনো লক্ষণই নেই। এবার জলিল ভাই বললেন_ আমি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল বলছি। ভাইসব আপনারা একটু থামুন। দয়া করে আমার কথা শুনুন। জনগণ থামল না বরং লাফালাফি এবং স্লোগানের শব্দ প্রকট হলো। একসঙ্গে কোরাস করে বলতে থাকল শেখ হাসিনা, শেখ হাসিনা...। জলিল ভাই একটু অভিমান বা রাগ করে জনতার উদ্দেশে বললেন_ ভাইসব একটু চুপ করুন। আমার কথা শুনুন। কাজ হলো না। আমরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে অসহায়ের মতো মঞ্চে দাঁড়িয়ে রইলাম। জনগণ তাদের নাচানাচি আরও বাড়িয়ে দিল। যুবক ও কিশোররা মাইকেল জ্যাকসনের মতো নাচ শুরু করল। জলিল ভাই মাইকেই বলতে শুরু করলেন_ এই ব্যাটারা চুপ কর। কাজ হলো না। এবার তিনি হুঙ্কার দিলেন_ আমি আবদুল জলিল বলছি, এই শালারা চুপ কর। জনগণ চুপ করল না বরং সর্বশক্তি নিয়োগ করে আরও জোরে জোরে স্লোগান দিতে আরম্ভ করল। জলিল ভাই ক্লান্ত, বিরক্ত এবং অসহায়েত্বের সর্বনিম্ন সীমায় পেঁৗছলেন। মাইকেই তিনি বলা শুরু করলেন_ 'ও কাদের! শালারা এমন করছে ক্যান'_ প্রায় পাঁচ মিনিট পর নেত্রী এলেন। জনগণ স্লোগান দিল। লম্বা করে। নেত্রী হাত নাড়ালেন। মনে হলো জনগণ যেন রাত ৮.৩০ মিনিটের সময় অমাবস্যার অন্ধকারে আকাশে চাঁদের দেখা পেলেন। এবার তিনি ইশারায় হাত নেড়ে জনগণকে শান্ত হতে বললেন। সব চুপ হয়ে গেল। একদম চুপ। পিন পতন নিরবতা এলো জনসভায়। তিনি বক্তব্য আরম্ভ করলেন। আমরা সূর্যের আলোর কাছে কেরোসিনের প্রদীপের মতো ম্রিয়মাণ হয়ে সভামঞ্চ থেকে নেমে পরবর্তী পথসভার উদ্দেশে রওনা করলাম।

এবার পাঠকদের জনসভা থেকে জাতীয় সংসদের একদম এসেম্বলি হলের ভেতরে নিয়ে যাই। বিএনপি যখন সংসদে থাকে তখন পরিবেশ হয় জমজমাট। আমরা সবাই সংসদের কাজে মনোযোগী থাকি। মনও থাকে প্রফুল্লময়। কিন্তু তাদের অনুপস্থিতিতে আমরা প্রায়ই বসে বসে নিজেদের মধ্যে খোশ গল্প করি। কেউ কেউ নিজের সিটে বসে গল্প করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েন। সিট ছেড়ে অন্য সহকর্মীর কাছে যান খোশগল্পের নতুন স্বাদ পাওয়ার জন্য। গল্প-স্বল্প এমনই জমে ওঠে যে, আমাদের কথা বার্তা এবং হাসির শব্দ উচ্চমার্গে পেঁৗছে যায়। আমরা গল্প করি এবং পিটপিট করে প্রধানমন্ত্রীর দিকে তাকাই। যদি বুঝি প্রধানমন্ত্রী আমাদের দিকে তাকিয়েছেন_ অমনি আমরা চুপ হয়ে যাই। কথাবার্তা হাসি থামিয়ে স্পিকারের দিকে গভীর মনোযোগের ভান করি। কেউ কেউ তো গালে হাত দিয়ে এমনভাবে বসে থাকার চেষ্টা করেন যেন মনে হয় তিনি ধ্যানে আছেন। কিন্তু সংসদ নেত্রী চোখ ফেরানো মাত্র আমাদের অনেকের গাল থেকে হাত নেমে যায় এবং শুরু করি তাই যা বলছিলাম অনেকক্ষণ ধরে। এ অবস্থায় যদি প্রশ্ন করি_ 'প্রধানমন্ত্রী হব ক্যামনে'_ তা কি খুব অন্যায় হবে?

লেখক : রাজনীতিক