আজ পৃথিবী ধ্বংস, না নতুন করে শুরু?

1 2 3 4
পৃথিবী টিকে থাকবে, নাকি প্রলয়ের ঘূর্ণাবর্তে পড়ে হারিয়ে যাবে কালের গর্ভে? এমন এক দোলচলে আজ দুলছে বিশ্বের অনেক মানুষ। কারণ, মায়া সভ্যতার বর্ষপঞ্জির হিসাব অনুযায়ী ২০১২ সালের ২১ ডিসেম্বর—আজকের এই দিনটিতে এই ধরাধাম ধ্বংস হওয়ার আভাস রয়েছে।
অনেকে আবার বলছেন, আজকের এই দিনটিতে মায়া বর্ষপঞ্জিতে দিনক্ষণের বিলুপ্তি ধ্বংসের আভাস নয়, বরং নতুন যুগের সূচনার ইঙ্গিত।
রয়টার্সের খবরে জানানো হয়, ২০ ডিসেম্বর থেকে অনেক দর্শনার্থী ভিড় করেছেন মেক্সিকোর মায়া সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া প্রত্নতাত্ত্বিক প্রাচুর্যে ভরা ঐতিহাসিক স্থানগুলোতে। নতুন মায়া যুগের সূচনাপর্বের অভিজ্ঞতা নিতে সেখানে জড়ো হয়ছেন তাঁরা।
২০১২ সালের ২১ ডিসেম্বর শেষ হয়ে যাচ্ছে মায়া সভ্যতার বর্ষপঞ্জি ১৩ বাখতুম আর শুরু হচ্ছে ১৪ বাখতুমের। ৪০০ বছরকে এক বাখতুম বা এক বৃত্ত ধরা হয়।
২৫০ থেকে ৯০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে মেক্সিকো ও মধ্য আমেরিকার বিশাল অঞ্চলজুড়ে বিকাশ লাভ করেছিল এই মায়া সভ্যতা। এর বেশ কিছু নিদর্শনের মধ্যে রয়েছে কয়েক হাজার বছর ধরে চলা এই বর্ষপঞ্জি।
দক্ষিণ আমেরিকায় ইউরোপীয় উপনিবেশ স্থাপনের আগে এই বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করত ওই অঞ্চলের মানুষ। পরে গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জি চালু হয়। সেই বিখ্যাত মেসো-অ্যামেরিকান লং কাউন্ট ক্যালেন্ডার পাঁচ হাজার ১২৫ বছরের বৃত্ত শেষ করছে আজ ২১ ডিসেম্বর।
এ কারণে গুঞ্জন শুরু হয়েছিল, আজই পৃথিবীর শেষ দিন। এর সঙ্গে যুক্ত করা হয় সুমেরীয়দের আবিষ্কৃত গ্রহ নিবিরু আর পৃথিবীর কক্ষপথ একই রেখায় চলে আসার তত্ত্ব। ধারণা করা হয়, এ দুইয়ের মুখোমুখি সংঘর্ষে হঠাত্ দুলে উঠবে পৃথিবী। বদলে যাবে আহ্নিক গতি। ঘুরতে শুরু করবে উল্টো দিকে! উত্তর মেরু চলে যাবে দক্ষিণ মেরুতে আর দক্ষিণ মেরু উত্তর মেরুতে। পশ্চিম দিকে অস্ত নয়, উদয় হবে সূর্যের! নড়তে শুরু করবে মহাদেশীয় প্লেটগুলো। ফুঁসে উঠবে মৃত, সুপ্ত, অর্ধসুপ্ত সব আগ্নেয়গিরি। দেখা দেবে প্রবল জলোচ্ছ্বাস। বেড়ে যাবে সূর্যের উত্তাপ; উত্তাপ বাড়বে পৃথিবীরও। গলিত লাভার মতো গলে যেতে শুরু করবে পৃথিবী।
ষাটের দশকেই মায়া সভ্যতার এ বর্ষপঞ্জি বিশ্লেষণ করে মার্কিন গবেষকেরা ধারণা করেছিলেন, পৃথিবী ধ্বংসের দিন হতে পারে ২০১২ সালের ২১ ডিসেম্বর শুক্রবার। তবে এ ধারণাও জন্মে, মায়া সভ্যতার বর্ষপঞ্জিতে আর কোনো তারিখ না থাকায় নতুন আরেকটি যুগ বা সময় শুরু হতে যাচ্ছে। যে যুগ হবে সমৃদ্ধি, জ্ঞান ও অমিতশক্তির। আজ সেই দিন।
আর নতুন যুগের সূচনালগ্নের অভিজ্ঞতা নিতেই বিভিন্ন পেশার মানুষ মেক্সিকোর মায়া সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ চিচেন ইটজার কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার বাসিন্দা সামবালা সংস্টার বলেন, ‘নতুন মায়া সভ্যতার সূচনায় মানুষের জ্ঞান বেড়ে যাবে। আমরা অমিতশক্তির অধিকারী হব আর অনেক বেশি আনন্দ ও উচ্ছ্বাসে পূর্ণ হব।’
গতকাল বৃহস্পতিবার থেকে চীনের বিভিন্ন এলাকায় ২১ ডিসেম্বর নিয়ে তৈরি হয়েছে ভীতি। পৃথিবীর শেষ দিন মনে করে ছড়াচ্ছে গুজব। ফ্রান্সের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ২১ ডিসেম্বর নিয়ে বিভিন্ন প্রবন্ধ ও নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হলে শুধু ফ্রান্সের একটি পর্বত ছাড়া আর কিছুই রক্ষা পাবে না বলে সেখানে সৃষ্টি হয়েছে ভীতি। সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন ওয়েবসাইটেও ২১ ডিসেম্বর নিয়ে নানা রকম গুজব ছড়াচ্ছে।
পৃথিবী ধ্বংসের এমন পূর্বাভাস অবশ্য নতুন নয়। এর আগে ২০১১ সালের ২১ অক্টোবর পৃথিবী ধ্বংস হচ্ছে বলে দাবি করেছিলেন ‘রেডিও মুঘল’ হ্যারল্ড ক্যাম্পিং।
টাইম অনলাইনের প্রতিবেদনে বলা হয়, ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক ফ্যামিলি রেডিও নেটওয়ার্কের মালিক হ্যারল্ড। এর আগে হ্যারল্ড ঘোষণা দিয়েছিলেন, ২১ মে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সবকিছুই ভুল প্রমাণ করে পৃথিবী টিকে রয়েছে নিজের মতো করেই।
মায়া সভ্যতার বর্ষপঞ্জিতে ২১ ডিসেম্বরের পর আর কোনো তারিখ না থাকায় এদিন পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে বলে যে ধারণা ও ভীতির সৃষ্টি হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণাপ্রতিষ্ঠান নাসার গবেষকেরা বিষয়টিকে স্রেফ গুজব বলেই উড়িয়ে দিয়েছেন। নাসার ওয়েবসাইটে ‘বিয়ন্ড ২০১২: হোয়াই দ্য ওয়ার্ল্ড উড নট এন্ড’ অংশে বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যাখার মাধ্যমে এ বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।
ওয়েবসাইটে নাসা উল্লেখ করেছে, মায়া বর্ষপঞ্জি অনুসারে ২১ ডিসেম্বর পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা নেই। মায়া ক্যালেন্ডারে ২১ ডিসেম্বর থেকে আর তারিখ না থাকার অর্থ ২২ ডিসেম্বর থেকে নতুন করে সময় শুরু হওয়া।
নাসার গবেষকদের ভাষ্য, আগামী কয়েক দশকের মধ্যে সব গ্রহ এক সারিতে আসার কোনো আশঙ্কাও নেই। নিবিরু নামের এক গ্রহ পৃথিবীতে আছড়ে পড়ে পৃথিবী ধ্বংস হবে, এটা কেবল ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়া একটা গুজব। এ বছর পৃথিবীর সঙ্গে কোনো গ্রহাণুর সংঘর্ষের কোনো আশঙ্কা নেই বলেও দাবি করেন গবেষকেরা।
নাসার গবেষকেরা জানান, ২১ ডিসেম্বর পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যেতে পারে—এ গুজবের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। এগুলো বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি, চলচ্চিত্রনির্ভর।
মায়া সভ্যতার দেখতে যাওয়া অধিকাংশ দর্শনার্থীরাই মনে করছেন মায়া সভ্যতার সূচনালগ্ন পৃথিবীতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে।
ফ্লোরিডা মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্টোরির গবেষক সুসান মিলবার্থ মনে করেন, মায়ার ভবিষ্যদ্বাণী আসলে ভুয়া। চতুর অনেক পণ্ডিত তাদের বই বিক্রির জন্য এ ধরনের ছল-চাতুরীর আশ্রয় নিতে পারে।
তবে মেক্সিকোতে জড় হওয়া দর্শনার্থীদের অনেকেই আশা করছেন তারা ভিনগ্রহের কোনো প্রাণী বা ভিনগ্রহবাসীদের যান (ইউএফও) দেখতে পাবেন। ভীনগ্রহের কোনো প্রাণীর দেখা পেলে তার কাছে পৃথিবীর কল্যাণের জন্য সহায়তা চাইবেন তাঁরা।